বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
ছোট্র একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী রহিমা খাতুনের সাথে মকবুল হোসেনের ঝগড়া হয়। সামান্য ঝগড়াঝাটির প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে মনগড়া ঘটনা সাজিয়ে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনে মকবুলকে আসামি করে কুষ্টিয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালে মামলা দায়ের করেন। আদালত বাদিনী রহিমা খাতুনের জবানবন্দি গ্রহনান্তে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি’র উপর তদন্ত দেন। ওসি তার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলেন যে, তদন্তকালে বাদিনীর অভিযোগে বর্ণিত ঘটনাটি অর্থাৎ রাত ৯টার সময় তাদের বাড়িতে কোনো প্রকারের ঘটনা ঘটেনি। আসামী মকবুল হোসেন কর্তৃক বাদিনীকে ধর্ষণের চেষ্টা করার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। তদন্তুকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য, প্রমাণ, পারিপার্শি¦কতা ও ঘটনাপ্রবাহে বাদিনীর আনীত ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন/২০০৩) আইনের ৯(৪)খ ধারার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
এ খবর পেয়ে বাদিনী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন আদালত চত্ত্বরে। অতপর একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে এ ঘটনাটি দিয়ে আর কীভাবে মকবুলকে হয়রানি করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে রহিমা খাতুন সে মতে একটি নারাজি দায়ের করেন। শুরু হলো আদালত পাড়ায় দুই পক্ষের দৌড়ঝাঁপ। আসামি মকবুল হোসেন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নারী ও শিশু নির্যাতনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সকল মামলার নারাজি মঞ্জুর করা হয়। সে ক্ষেত্রে নারাজি গ্রহণ হলে বিচার প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবেশ করতে হবে। কথিত আসামি মকবুল পরবর্তীতে আইনি ঝামেলা এড়িয়ে চলার লক্ষ্যে বাদিনীর দালালদের সঙ্গে মামলা তুলে নেয়ার বিষয়ে আলোচনায় বসেন। অবশেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বাদী ও আসামীর সঙ্গে সমোঝাতায় উপনীত হন। দালালেরা টাকা গ্রহণের পর বাদিনীকে বলেন মামলা তুলে নেয়ার জন্য। সে মতে বাদিনী পরবর্তী তারিখে আদালতে এসে বিচারকের সামনে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তিনি আর নারাজি দাখিল করবেন না। এমনকি আসামির বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগও নেই। যে অভিযোগটি ছিলো তা সম্পূর্ণই ভুল বোঝাবুঝি। ব্যাস, সকল অভিযোগের অবসান ঘটল, মামলাও সমাপ্ত হলো।
সারা দেশে এরকম বহু ঘটনাই ঘটছে, যেখানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কঠোর বিধানের অপব্যবহার করে হয়রানিমূলক মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। দেশের ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের অপরাধগুলোর কঠোর শাস্তিবিধানের জন্য ১৯৮৩ সালে প্রথম নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ নামে একটি আইন জারি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশটি রহিত করা হয়। পরে মামলা পরিচালনাকালে এ আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করা হয়। পাশাপাশি ১৯৯৫ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন’টি বিলুপ্ত করা হয়। ২০০০ সালের আইনটিই বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য প্রচলিত আইন হিসেবে বলবৎ আছে। এর পরে অবশ্য ২০০৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
কিন্তু আইনটির কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগও উঠছে দেশজুড়ে। মামলা দায়েরের পর তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হলে আগে থেকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়া লোকজন দিয়ে একতরফা জবানবন্দি প্রদানের মাধ্যমে মামলাটি আমলে নেয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত আসামি জানতেও পারে না যে প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডও হতে পারে।
এদিকে ধর্ষণ চেষ্টার মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বাদী ফিরোজা বেগমকে এক বছরের কারাদ-ে দ-িত করেন । জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে চাচাতো বোনের স্বামী গিয়াস উদ্দিন গোপালসহ তিন জনের বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত এ রায় দেন। কারাদ- ছাড়াও বাদীকে আরও বিশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের সাজা দেয় আদালত। তবে রায়ের পর ওই নারী আপিলের শর্তে জামিনের প্রার্থনা করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। আদালত সূত্রে জানা যায়, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে আসামি ফিরোজা বেগম তার চাচাতো বোনের স্বামী গিয়াস উদ্দিন গোপালসহ তিন জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা মর্মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে মিথ্যা মামলা করায় বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন। মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে গিয়াস উদ্দিন গোপাল ওই মামলার বাদী ফিরোজার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মামলা করলে বিচার শেষে বিচারক এ দ- দেন। এ ধারায় বলা আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করে বা করায় তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যে অভিযোগ দায়ের করিয়েছে ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-নীয় হবে। উপধারা (২) মতে, কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল উপধারা (১)-এর অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবে।
সুতরাং, মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের শিকার হলে বিবাদী আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্য দিয়ে প্রতিকার পেতে পারে। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদ- হতে পারে। বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে। নারী নির্যাতন ঠেকাতে উল্লিখিত আইনটি যথার্থভাবে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হোক, কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার না হোক সেটাই সবার প্রত্যাশা। ১৭ ধারার প্রতিকার কিভাবে ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮